সারা দেশে অনলাইনে গেমস তিনপাত্তি গোল্ডের ৯ লাখ গ্রাহক রয়েছে। এই গেমের মাধ্যমে দেশ থেকে ২৯ কোটি টাকা পাচার হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশে। উল্কা গেমস লিমিটেড গেম ডেভেলপমেন্টের ভুয়া চুক্তির কথা বলে বৈধ উপায়ে ২৯ কোটি টাকা পার্শ্ববর্তী দেশের কোম্পানি মুনফ্রগ ল্যাবের কাছে পাঠিয়েছে। তবে অবৈধভাবে পাচার হওয়া টাকার সংখ্যা আরও কয়েক গুণ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি তিনপাত্তি গোল্ডসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা দেশের বাইরে পাঠানো চক্রের মূলহোতা উল্কা গেমস লিমিটেডের সিইও জামিলুর রশিদসহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪। রাজধানীর মহাখালী ও উত্তরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তাররা হলেন— জামিলুর রশিদ (৩১), সায়মন হোসেন (২৯), মো. রিদোয়ান আহমেদ (২৯), মো. রাকিবুল আলম (২৯), মো. মুনতাকিম আহমেদ (৩৭) ও কায়েস উদ্দিন আহম্মেদ (৩২)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ, সিপিইউ, সার্ভার স্টেশন, হার্ড ডিস্ক, স্ক্যানার, ডিভিডি ড্রাইভ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ডেভিড ও ক্রেডিট কার্ড এবং পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র ও নগদ টাকাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে।
সোমবার (৩১ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালে পার্শ্ববর্তী দেশের প্রতিষ্ঠান মুনফ্রগ ল্যাবের সঙ্গে জামিলুর রশিদের পরিচয় হয়। পরে ২০১৮ সালে তিনি মুনফ্রগ ল্যাবের বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে দেড় লক্ষাধিক টাকা বেতনে নিযুক্ত হয়। মুনফ্রগ ল্যাবের অনলাইন জুয়া অ্যাপ ‘তিনপাত্তি গোল্ড’ এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় গেমটিকে আরও ছড়িয়ে দিতে দেশে কাজ শুরু করে জামিলুর ও তার সহযোগীরা। এছাড়া গেমটিকে দেশে বৈধতা দিতে কয়েকজন আইনজীবীর পরামর্শে ২০১৯ সালে ‘উল্কা গেমস প্রা. লি.’ নামে একটি গেমিং ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেয় জামিলুর। পরে ২০১৯ সালে মুনফ্রগের ০.০১ শতাংশ উল্কা গেমসকে দেওয়ার মাধ্যমে দেশে গেমিং খাতে উন্নয়নের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা প্রদানের মাধ্যমে ভুয়া চুক্তিবদ্ধ হয়। দেশে গেম ডেভেলপমেন্টের অনুমোদন থাকলেও অনলাইন জুয়া/ক্যাসিনোর অনুমোদন না থাকায় উল্কা গেমস বিভিন্ন ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে আইনি বৈধতা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে। এভাবে ‘তিনপাত্তি গোল্ড’ যাত্রা শুরু করে শহর-নগরে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন : অবসরে যাচ্ছেন সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, উল্কা গেমসের যাত্রা গেমিং ডেভেলপমেন্টের উদ্দেশে শুরু হলেও তারা মূলত গেম ডেভেলপমেন্ট না করে তিনপাত্তি গোল্ডসহ বিভিন্ন অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাঠানোর কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। ‘তিনপাত্তি গোল্ড’ মূলত একটি অ্যাপ, যা মোবাইলে ডাউনলোড করে খেলা যায়। এই অ্যাপের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ মুনফ্রগ ল্যাবের কাছে। এই অ্যাপে ‘তিনপাত্তি গোল্ড’ ছাড়াও রাখি, আন্দর বাহার ও পোকার নামেও অনলাইন জুয়ার গেমস রয়েছে। যেকোনো কাজের পাশাপাশি এই গেম খেলতে পারায় তরুণসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে এটি জনপ্রিয়তা পায়। রেজিস্ট্রেশনের পর একজন গ্রাহককে গেম খেলার জন্য কিছু চিপস ফ্রি দেওয়া হয়। পরে গেম খেলার জন্য অর্থের বিনিময়ে চিপস কিনতে করতে হয়। মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে চিপস কেনার অর্থের লেনদেন হয়। জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় ৫০ হজার কোটি চিপস বিক্রি হয় এবং প্রতি কোটি চিপস বিভিন্ন পর্যায়ে ৪৬-৬৫ টাকায় বিক্রি করা হয়।
তিনি বলেন, বিভিন্ন বট প্লেয়ার/রোবট প্লেয়ারের মাধ্যমে মূল গেমারদের কৌশলে হারিয়ে প্লেয়ারদের পরে আরও চিপস কিনতে উৎসাহিত করা হয়। বাংলাদেশে ‘তিনপাত্তি গোল্ড’ এর চিপস বিক্রির কাজটি ১৪টি অফিসিয়াল ডিস্ট্রিবিউটর/এজেন্টের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। এসব ডিস্ট্রিবিউটরদের সাব ডিস্ট্রিবিউটর রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও প্রাইভেট টেবিল অপশনের মাধ্যমে অন্য প্লেয়ার থেকেও চিপস কেনা যায়। বর্তমানে ‘তিনপাত্তি গোল্ড’ এ প্রায় ৯ লাখ নিয়মিত গেমার রয়েছে এবং প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার চিপস বিক্রি হয় বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন : জনপ্রশাসনের নতুন সিনিয়র সচিব মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, ভার্চুয়াল চিপস অর্থের বিনিময়ে ডিস্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মূলত বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে চিপস বিক্রির টাকা ডিস্ট্রিবিউটরদের থেকে সংগ্রহ করা হতো। বর্তমানে উল্কা গেমসের চারটি অ্যাকাউন্টে ৮০ কোটির বেশি টাকা রয়েছে বলে জানা যায়। এছাড়াও গত দুই বছরে তারা মুনফ্রগ ল্যাবকে ব্যাংকের মাধ্যমে ২৯ কোটি টাকা দিয়েছে। উল্কা গেমসের মোট ৩৬ জন কর্মকর্তা/কর্মচারী ছিল। বেতনসহ অফিস পরিচালনায় প্রতি মাসে প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হতো। এছাড়াও কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বাৎসরিক বেতনের ৩০-৯০% হারে বোনাস দেওয়া হতো। প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেশের বাইরে অনলাইন জুয়ার অর্থ পাঠানো হয়েছে।